গাজা থেকে ফিরে ট্রমা, আত্মহত্যা করেছেন অনেক ইসরায়েলি সেনা

৪০ বছর বয়সী চার সন্তানের বাবা এলিরান মিজরাহি। ইসরায়েলের একজন সেনাসদস্য ছিলেন। গত বছর ইসরায়েলে হামাসের হামলার পর গাজায় লড়াই করতে পাঠানো হয়েছিল তাকে। যুদ্ধ এখনও চলছে। এরই মাঝে গাজা থেকে ইসরায়েলে ফিরিয়ে আনা হয় আহত এলিরানকে। তবে তত দিনে একজন ভিন্ন মানুষে পরিণত হয়েছিলেন তিনি। গাজায় যুদ্ধ করতে গিয়ে এলিরান যা দেখেছিলেন, তাতে মানসিকভাবে বড় আঘাত পান। সেখান থেকে ফেরার পর চরম ট্রমায় (অবসাদ) ভুগছিলেন। এর ফল মোটেও ভালো হয়নি। পুনরায় গাজায় পাঠানোর আগে আত্মহত্যা করেন তিনি। এলিরানের মা জেনি মিজরাহি সিএনএনকে বলেন, ‘সে গাজা ছেড়েছিল, তবে গাজা তাকে ছাড়েনি। সেই ট্রমায় ছেলে মারা গেল।’ এলিরান যে মানসিক সমস্যায় ভুগছিলেন, চিকিৎসাশাস্ত্রের ভাষায় তার একটি নাম রয়েছে। একে বলা হয়, ‘পোস্টট্রমাটিক স্ট্রেস ডিজঅর্ডার’ (পিটিএসডি)। গাজা থেকে ফেরার পর ইসরায়েলের হাজার হাজার সেনা পিটিএসডিসহ নানা মানসিক সমস্যায় ভুগছেন। তবে তাদের কতজন আত্মহত্যা করেছেন, তা সুনির্দিষ্টভাবে জানা যায়নি। ২০২৩ সালের ৭ অক্টোবরে ইসরায়েলে হামাসের হামলায় নিহত হন ১ হাজার ২০০ জন। এরপর থেকে ইসরায়েলের নৃশংস হামলায় তছনছ পুরো গাজা। যত দিন যাচ্ছে লাশের সংখ্যা বাড়ছে। সেখানে এখন পর্যন্ত নারী ও শিশুসহ ৪২ হাজারের বেশি মানুষ নিহত হয়েছেন। এরই মধ্যে আবার লেবাননে হামলা শুরু করেছে ইসরায়েল। এ বিষয়ে এলিরান মিজরাহির বোন শির বলেন, সেনাবাহিনীর কারণে, এই যুদ্ধের কারণে, আমার ভাই আর আমাদের মাঝে নেই। সে যুদ্ধে গুলিতে বা রকেট প্রপেলড গ্রেনেডের আঘাতে মারা যায়নি। তবে অদৃশ্য এক গুলি তার জীবন কেড়ে নিয়েছে। গাজায় চার মাস ছিলেন ইসরায়েলের প্রতিরক্ষা বাহিনীর (আইডিএফ) একজন চিকিৎসক। পরিচয় প্রকাশ না করার শর্তে সিএনএনকে তিনি বলেন, গাজার পর এখন অনেক সেনাকে লেবাননে পাঠানো হতে পারে—এই ভয় পাচ্ছেন তারা। ইসরায়েলি বাহিনীর বহু সেনাসদস্য এখন প্রধানমন্ত্রী নেতানিয়াহুর সরকারকে বিশ্বাস করেন না। গাজায় সচরাচর বিদেশি সাংবাদিকদের প্রবেশ করতে দেয় না ইসরায়েল সরকার। যারা এ সুযোগ পাচ্ছেন, তাদেরও ইসরায়েলি বাহিনীর পাহারা ও নজরদারির মধ্যে থাকতে হচ্ছে। ফলে ইসরায়েলের হামলায় গাজার ফিলিস্তিনিদের কতটা দুর্দশার মধ্যে দিন কাটাতে হচ্ছে বা সেখানে ইসরায়েলি সেনারা কেমন অভিজ্ঞতার মধ্যে রয়েছেন, সে চিত্রটা পাওয়া কঠিন হয়ে পড়েছে। গাজায় লড়াই করা ইসরায়েলি সেনারা সিএনএনকে জানিয়েছেন, উপত্যকাটিতে তারা যে ভয়াবহতা দেখেছেন, তা বাইরের মানুষ সত্যিকার অর্থে কল্পনাও করতে পারবেন না। এই বক্তব্য থেকে উপত্যকাটিতে চলমান নৃশংসতা সম্পর্কে একটা আঁচ পাওয়া যায়। সমালোচকদের ভাষায়—নেতানিয়াহু এই নৃশংসতার নাম দিয়েছেন ‘চিরকালের যুদ্ধ’। ‘আমি যে কী দেখে এসেছি, তা কেউ বুঝবে না’: এলিরানকে গাজায় মোতায়েন করা হয়েছিল গত বছরের ৮ অক্টোবর। তার কাজ ছিল ডি–৯ মডেলের একটি বুলডোজার চালানো। ৬২ হাজার কেজি ওজনের এই যানটি গুলি ও বোমা হামলার মুখেও টিকে থাকতে পারে। হামাসের হামলার পর নিজ আগ্রহে ইসরায়েলের সামরিক বাহিনীতে যোগ দিয়েছিলেন এলিরান। এর আগে তিনি কাজ করতেন দেশটির একটি নির্মাণপ্রতিষ্ঠানে। গাজায় ১৮৬ দিন ছিলেন এলিরান। চলতি বছরের ফেব্রুয়ারি মাসে তার বুলডোজারে হামলা চালানো হয়। এতে হাঁটুতে আঘাত পান তিনি। তারপর চিকিৎসার জন্য গাজা থেকে ইসরায়েলে ফিরিয়ে নেয়া হয় তাকে। এপ্রিলে তাকে পিটিএসডির চিকিৎসা দেয়া শুরু হয়। প্রতি সপ্তাহেই থেরাপি নিচ্ছিলেন। তবে এই চিকিৎসা তার জীবনে কোনো কাজে আসেনি। গাজা থেকে ফেরার পর অল্পতে রেগে যেতেন এলিরান, রাতের পর রাত ঘুম হতো না। প্রচুর ঘামতে তিনি। পরিবারকে বলতেন, গাজায় তিনি যে কী অবস্থার মধ্য দিয়ে গেছেন, তা কেবল সেখানে তার সঙ্গে থাকা ব্যক্তিরাই বুঝবেন। এলিরানের বোন শির সিএনএনকে বলেন, ‘সে সব সময় বলতো, “আমি যে কী দেখে এসেছি, তা কেউ বুঝবে না।”’ আত্মহত্যা করা এই ইসরায়েলি সেনার মা বলছিলেন, ‘সে অনেককে মারা যেতে দেখেছে। হয়তো কাউকে হত্যাও করেছে। তবে সন্তানদের এসব করার শিক্ষা আমরা দিই না। তাই যখন সে এমন কিছু করেছিল, তখন হয়তো বড় একটা ধাক্কা খেয়েছিল।’ মাংস খেতে পারেন না অনেকে: গুই জাকেন, এলিরানের এই বন্ধু গাজায় তার সঙ্গে বুলডোজার চালাতেন। তিনি এখন মাংস খেতে পারেন না। খাওয়ার সময় গাজায় বুলডোজারের ভেতর থেকে দেখা নানা দৃশ্যের কথা তার মনে পড়ে। ঘুমাতে গেলে একপ্রকার সংগ্রাম করতে হয়। কারণ, তার কানে সব সময় বাজে বিস্ফোরণের শব্দ। গাজায় যেসব মরদেহ দেখেছেন, সেগুলোকে এখন ‘মাংসের’ মতো মনে হয় গুই জাকেনের কাছে। তিনি বলেন, ‘আপনি যখন বুলডোজারের বাইরে তাদের (ফিলিস্তিনি) ও আমাদের (ইসরায়েলি সেনা) প্রচুর রক্ত ও মাংস পড়ে থাকতে দেখবেন, তখন তা সত্যিকার অর্থে আপনার খাবারের ওপর প্রভাব ফেলবে।’ ইসরায়েলের এক সেনা বলেন, ইসরায়েলি সেনাদের মধ্যে একটা ধারণা তৈরি হয়েছে যে, ‘গাজার বেসামরিক লোকজন খারাপ। কারণ, তারা হামাসকে সাহায্য করে।’ গাজায় বেসামরিক ফিলিস্তিনিদের মুখোমুখি হলে ইসরায়েলি সেনারা নৈতিকভাবে একধরনের দোটানার মধ্যে পড়েন বলে জানিয়েছেন আইডিএফের একজন চিকিৎসক। পরিচয় প্রকাশ না করার শর্তে তিনি বলেন, গাজাবাসীকে নিয়ে ইসরায়েলি সেনাদের মধ্যে অবিশ্বাসের দৃষ্টিভঙ্গি তৈরি হয়েছে। তাদের মধ্যে একটা ধারণা তৈরি হয়েছে যে, ‘গাজার বেসামরিক লোকজন খারাপ। কারণ, তারা হামাসকে সাহায্য করে। তাদের গোলাবারুদ লুকিয়ে রাখে।’ বুলডোজার দিয়ে সরানো হয় মরদেহ যুক্তরাজ্যের কিংস কলেজ লন্ডনের রাষ্ট্রবিজ্ঞানী আহরন বার্গম্যান। ১৯৮২ সালে লেবানন যুদ্ধের সময়সহ মোট ছয় বছর তিনি ইসরায়েলি বাহিনীর হয়ে কাজ করেছেন। তার মতে, ইসরায়েল এখন পর্যন্ত যতো যুদ্ধ করেছে, তার চেয়ে এবারের যুদ্ধ ভিন্ন। বার্গম্যান বলেন, এবারের যুদ্ধ শহর এলাকায় দীর্ঘ সময় ধরে চলছে। সেনাদের বহু মানুষের মধ্যে লড়তে হচ্ছে। তাদের অধিকাংশই বেসামরিক। বার্গম্যানের ভাষ্যমতে, গাজায় ইসরায়েলি বাহিনীর যেসব সদস্য সরাসরি যুদ্ধের মুখে পড়ছেন, তাদের মধ্যে রয়েছেন বুলডোজার চালকেরা। তারা মৃত মানুষ দেখছেন। ধ্বংসাবশেষের সঙ্গে মরদেহগুলোও তাদের বুলডোজার দি

অক্টোবর 22, 2024 - 13:22
 0  0
গাজা থেকে ফিরে ট্রমা, আত্মহত্যা করেছেন অনেক ইসরায়েলি সেনা

আপনার অনুভূতি কী?

like

dislike

love

funny

angry

sad

wow