জয়পুরহাটের নবান্ন উৎসব।

লেখক আউলিয়া পারভীন - বাংলাদেশে রয়েছে বারোটি মাস।প্রতি দুই মাস মিলে হয় একটি খতু।প্রতিটি ঋতুর রয়েছে মৌলিক কিছু বৈশিষ্ট্য,যা দিয়ে খুব সহজেই আলাদা ভাবে চিহৃিত করা যায়। ষড়ঋতুর বৈশিষ্ট্য অনুযায়ী এখন চলছে হেমন্ত কাল।এটি হলো চতুর্থতম ঋতু।কৃত্তিকা ও আদ্রা এ দুটি তারার নামেই কার্তিক আর অগ্রহায়ণ নাম করা হয়। হেমন্ত ঋতুতে দুপুরের রোদের তেজ কমতে শুরু করে।আস্তে আস্তে বেলা ছেট হতে থাকে।চট করেই যেনো সন্ধ্যা নেমে যায়।ত্বকে টান টান ভাব অনুভব হয়।উত্তর দিক থেকে রয়ে আসা বাতাসে হালকা হিমের ছোঁয়া। হালকা কুয়াশায় গাছের পাতা ও ঘাসের ডগায় সাদা মুক্তো দানার মতো জমে থাকে শিশির বিন্দু। নানা রকম ফুলে আর সৌরভে ভরে উঠে প্রকৃতি।শিউলি ফুলে ভরে থাকে ভোর বেলার আঙ্গিনা। এছাড়া,চন্দ্র মল্লিকা,দেব,কাঞ্চন, ছাতিম,মিষ্টি গন্ধের কামিনী,গন্ধরাজ সহ নানা রকম ফুলের সমারোহ। নারিকেল হলো হেমন্তের প্রধান ফল।এছাড়া কামরাঙা, চালতা,কদবেল,আমলকি,ডালিম, ইত্যাদি ফলের সমারোহ দেখা যায় এ ঋতুতে। এসময় ঘরে ঘরে নতুন ধান তোলার আনন্দে মেতে উঠে গ্রাম বাংলার মানুষ।এ ঋতুর প্রধান বৈশিষ্ট্য হলো নবান্ন উৎসব। একসময় বাংলার বছর শুরু হতোএ ঋতুর অগ্রহায়ণ মাস হিসাব ধরে।নববর্ষ পালিত হতো ঋতুধর্মী উৎসব হিসেবে অগ্রহায়ণ। তখন এর সঙ্গে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক ছিলো কৃষির।এ মাসেই নতুন ধানের চালে পালিত হতো নবান্ন। ডঃ নীহাররন্জ্ঞন রায়ের মতে,বাঙ্গালির নব বর্ষের উৎসব ছিলো নবান্ন। নবান্ন শব্দের অর্থ নতুন অন্ন।আর এ উৎসব হলো আমন ধান কাটার পর সেই ধান থেকে প্রস্তুতকৃত চালের প্রথম রান্না উপলক্ষে আয়োজিত উৎসব। বাংলাদেশ ও ভারতের পশ্চিম বঙ্গের ঐতিহ্যবাহী একটি উৎসব হলো, এই শষ্যভিত্তিক লোকজ উৎসব নবান্ন।যুগ যুগ ধরে এ উৎসব পালিত হয়ে আসছে অগ্রহায়ণ মাসের এক তারিখ। এ দেশের সকল ধর্মীয় জনগোষ্ঠীর নিকট এ উৎসব একটি সার্বজনীন উৎসব।তবে নবান্ন উৎসব নানা ভাবে পালিত হতে দেখা গেছে।যপমন,উত্তর পশ্চিম ও দক্ষিণ ভারতে বৈশাখে রবি শষ্য গম ঘরে তোলার আনন্দে নবান্ন পালন হয়। সাঁওতাল, উসুই,গারো,জুম চাষী ম্রো উপজাতি পৌষ ও মাঘ মাসের শীতকালীন প্রধান ফসল ঘরে তুলে উদযাপন করে এ উৎসব। আবার হিন্দু সম্প্রদায়ের মধ্যে হেমন্তের আমন ধান কাটার পর রয়েছে এ উৎসবের নানা আয়োজন। তাদের উৎসবের প্রধান অঙ্গ ছিলো নতুন চালে পিতৃপুরুষের শ্রাদ্ধ করা।পরে দেবতা,অগ্নি,কাক,ব্রাক্ষ্মণ ও আত্মীয় স্বজনদের নিবেদন করে গৃহকর্তা ও তার পরিবারবর্গ নতুন গুড়সহ নতুন অন্ন গ্রহন করতেন।এ উপলক্ষে বাড়ির উঠোনে,ঘরের মেঝেতে আলপনা আঁকা হতো।জয়পুরহাট জেলাধীন সকল উপজেলায় যেসব মাটির তৈরি বাড়ি আছে সেগুলোর দেয়ালে সুন্দর সুন্দর আলপনায় রঙ্গিন করে তোলত গৃহ কণ্যা ও বধূগণ।প্রতিটি গ্রামের মেঠো পথ আর গৃহের পরিবেশ হয়ে উঠত সৌন্দর্যপূর্ণ ও আনন্দঘন মধুময়। সবখানেই গুড়ি কোটার শব্দ ও শাঁখের শব্দে,মূখরিত হয়ে উঠে। তেমনি মুখরিত হয়ে উঠে জয়পুরহাট সদর হতে ২২ কিলোমিটার পূর্বে কালাই উপজেলার বেগুনগ্রাম নামক জায়গাটি। প্রাকৃতিক সৌন্দর্যে এ গ্রাম বেশ সমৃদ্ধ। এখানকার সুজলা সুফলা সবুজ প্রকৃতি আর মনোরম পরিবেশ মুগ্ধ করার মতো। গ্রামের প্রত্যেকটা বাড়িতে নবান্নের আনন্দ আত্মীয় স্বজনের আনাগোনা । এখানে মোঃ আব্দুল বারী চৌধুরী পেশায় শিক্ষকতা করেন অবসর গ্রহন করার পর তার ছেলে মোঃ হেফজুল বারী চৌধুরী পেশায় একজন ডাক্তার হয়েও শত ব্যস্ততায় ধরে রেখেছেন এ উৎসব। উল্লেখ্য যে,এই চৌধুরী পাড়ায় আস্তানায়ে চিশতিয়া হযরত খাজা শাহ মাওলানা মোহাম্মদ আব্দুল গফুর চিশতী রাঃ এর খানকায়ে চিশতীয়ার দরবার শরীফ অবস্থিত।ভারতের হযরত খাজা মাওলানা মোহাম্মদ নাজিমুদ্দিন চিশতী রাঃ এর কাছে আধ্যাত্মিক দিক্ষা গ্রহণের পর তারই নির্দেশে বাংলা ১৩২৮ খ্রিষ্টাব্দে আস্তানা তৈরী করে। এখান থেকে ইসলাম প্রচার শুরু করেন।ধর্ম প্রচারের পাশাপাশি তিনটি বৃহৎ মাদ্রাসা,বহু মসজিদ,নির্মাণ করেন।এখানে রয়েছে সুন্দর একটি সান বাধানো সুবিশাল দীঘি। প্রতি বছর অগ্রহায়ণ মাসের প্রথম বৃহস্পতিবার এখানে এই নবান্নের আয়োজন করা হয়।রীতি অনুযায়ী এই আস্তানায় প্রবেশ করলে না খেয়ে কেউ ফিরে না। এই বছর বৃহস্পতিবার ১৬ ই নভেম্বর ২০২৩ তারিখের উক্ত স্থানের নবান্ন অনুষ্ঠানিত হয়।বাংলাদেশের বৃহত্তম হলো এই নবান্ন উৎসব।উৎসব ছিলো দিন জুড়ে মেলা।নতুন ধানের ৯০ মন চাল ১৩০ মন গুড়,৩ হাজার নারিকেল ও ৮০ মনের দুধের সমন্বয়ে ৩০ টি চুলায় রান্না করা ক্ষীর দিয়ে আপ্যায়ন করা হয় গ্রামবাসীকে।এছাড়া এই জেলা ধান,ফল আর ,আলুর জন্য বিখ্যাত।তাই নতুন চালের ক্ষীর,ভাত পাশাপাশি খাসীর মাংস দিয়ে আলু ঘাটি এক বিশেষ ও সুস্বাদু খাবারও এখানে আয়োজন করা হয়।আয়োজক কমিটির সদস্য মোহাম্মদ হেফজুল বারী চৌধুরীর ভাষ্যমতে, এখানে নববর্ষ পালন সেভাবে পালন না হলেও নবান্ন উৎসব খুবই জোড়ালো ও গুরুত্বের সাথে পালন করা হয়।এখানে হযরত শাহ সুফি আব্দুল গফুর চিশতী ১৩৩১ বঙ্গাব্দ হতে এ নবান্ন উৎসব শুরু করেন।সেই থেকেই প্রতি বছর অগ্রহায়ন মাসের প্রথম বৃহস্পতিবার সকাল হতে রাত ১২ পর্যন্ত এই উৎসব পালন করা হয়।উৎসব নিরাপত্তায় প্রতি বছরেই থাকে,আনসারগ্রাম্য পুলিশ ও পুলিশ বাহিনীর টিম। দূর হতে এখানে কেউ এলে থাকা খাওয়া ফ্রি এবংআপ্যায়ন যেনো আত্মীয়তার বন্ধনের কথা বলে। এছাড়া প্রত্যেক বাড়ি বাড়ি আলাদাভাবে প্রিয় স্বজনদের নিমন্ত্রণ আর উপহারের সমারোহ। এখানে এই দিন উপলক্ষে বিশেষ এক মেলার আয়োজন করা হয়।পাওয়া যায় না এমন জিনিস দূরহ। বাংলাদেশের যে কয়েকটি উপাদান লোকজীবনের সঙ্গে মিশে আছে তাদের মধ্যে বাঁশ,বেত আর মাটির জিনিস পত্র অন্যতম।এগুলোকে লোকজ শিল্ল বলা হয়।কাঠের তৈরী সরন্জামও কম নয়।যাইহোক,সাধারনত গ্রামের লোকেরা এ শিল্পের সঙ্গে জড়িত ও বেশির ভাগ তারাই এসব ব্যবহার করে।তবে বর্তমান এর চাহিদা নাগরিক জীবনেও শৌখিনতা আর সজ্জাতে কম নয়।ইহা ক্ষুদ্র নৃ গোষ্ঠীদের জীবনাচরণ ও অনুভূতির প্রতীক।। নবান্নের এই মেলাতে লোকজ শিল্পের দেখা মিলে।যেমন,হাত পাখা(,তাল পাখা, সুতার পাখা,কাপড়ের পাকা,) নানান সুরের বাঁশের বাশি,,ঢোল,গোলা,গুড়া,বাউনি,ঝুড়ি,ডুলা,মোড়া,কুলা,চালুন,খাঁচা মই,চাটাই,মাছ ধরার চাই, নানা রকমের মাছ

মে 28, 2025 - 23:35
 0  18
জয়পুরহাটের নবান্ন উৎসব।

আপনার অনুভূতি কী?

like

dislike

love

funny

angry

sad

wow