শিশু বর্ষা: একটি ভাঙা শৈশবের গল্প।
লেখক | আউলিয়া পারভীন | মির্জাপুর থানা এলাকা থেকে উদ্ধার হওয়া আনুমানিক সাত বছরের একটি মেয়েশিশু—যার মুখে উচ্চারিত একমাত্র শব্দ "বর্ষা", আর অন্যসব কথা যেন আটকে গেছে গলার কাছেই। অস্থির দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকা সেই মেয়েটির শরীরে আতঙ্ক, চোখে ভয়ের ছায়া। ভারসাম্যহীন অবস্থায় তাকে পাওয়া গেলে, স্থানীয় থানার মাধ্যমে হস্তান্তর করা হয় সরকারি শিশু সেবা প্রতিষ্ঠানে। সেখানেই তার শুরু হয় নতুন জীবনযাত্রা। গোলগাল চেহারার বর্ষা, দুধে-আলতা বর্ণের এই শিশুটির চেহারায় এক অপূর্ব কোমলতা। কিন্তু তার চেয়ে গভীরতর কিছু লুকিয়ে আছে—অতীতের ভয়াবহ অভিজ্ঞতা। প্রথম ১৫ দিন তাকে বিশেষ পর্যবেক্ষণে রাখা হয়, যার মধ্যে শিশুটির আচরণ, মনের অবস্থা, সামাজিকীকরণসহ মানসিক স্বাস্থ্য যাচাই করা হয়। এক ভয়াবহ স্মৃতির ছায়া বর্ষার মুখ থেকে ভাঙ্গা ভাঙ্গা শব্দ আর ইশারার মাধ্যমে যা বোঝা যায়, তা আরও করুণ—তার সামনেই তার মাকে গলা কেটে হত্যা করা হয়। পারিবারিক সহিংসতার সেই ভয়ংকর স্মৃতি তার কোমল মনে গভীর ছাপ ফেলে গেছে। বিশেষজ্ঞদের মতে, বর্ষা বর্তমানে পোস্ট ট্রমাটিক স্ট্রেস ডিসঅর্ডার (PTSD)-এ আক্রান্ত, পাশাপাশি রয়েছে ডিপ্রেশন, ইনসমনিয়া, সাইকোজেনিক ডিসঅর্ডার এবং Attention Deficit Hyperactivity Disorder (ADHD)-এর লক্ষণ। স্বাস্থ্যগত সমস্যা ও চিকিৎসা ব্যবস্থা বর্ষার আচরণে অনিয়মিততা লক্ষ করা যায়—কখনো চুপচাপ, কখনো হঠাৎ ফ্লোরে পড়ে গিয়ে খিঁচুনি, মুখে ফেনা ওঠা। এমন ঘটনা তিনবার ঘটার পর চিকিৎসার জন্য নেওয়া হয় জেলা সদর হাসপাতালে। সেখানকার শিশু মনোরোগ বিশেষজ্ঞরা তার মানসিক ও শারীরিক অবস্থা পর্যবেক্ষণ করে নিশ্চিত করেন, বর্ষা মারাত্মক মানসিক বিপর্যয়ের শিকার। নতুন পরিবেশে নতুন যাত্রা বর্তমানে বর্ষা সরকারি শিশু প্রতিষ্ঠানে অন্যান্য শিশুদের সাথে সময় কাটায়। সোনিয়া নামের এক সহপাঠী তার প্রিয় সঙ্গী হয়েছে। তারা একসাথে খায়, খেলে, গল্প করে। যদিও সোনিয়া বেশি কথা বলে, বর্ষা শুধু চুপচাপ শোনে আর কখনো কখনো হেসে ওঠে। বর্ষাকে দেওয়া হয়েছে প্রযোজনীয় ওষুধ, পোশাক, খাবার, ঘুমানোর আলাদা খাট, এবং বিনোদনের জন্য খেলনা। পাশাপাশি তাকে সাইকো-সোশ্যাল থেরাপি, গেম থেরাপি, সৃজনশীল কর্মকাণ্ডে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে, যাতে ধীরে ধীরে সে তার মানসিক ভারসাম্য ফিরে পায়। পারিবারিক সহিংসতা: শিশুমনে চিরস্থায়ী ক্ষত বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের ভাষ্য অনুযায়ী, পারিবারিক কলহ, মারামারি, অবহেলা শিশুর মস্তিষ্কের প্রাথমিক বিকাশে ভয়াবহ ক্ষতি করে। শিশুর নিরাপত্তাহীনতা, উদ্বেগ, বিষণ্ণতা, আত্মবিশ্বাসহীনতা ও অমনোযোগিতার জন্ম হয়। অনেক সময় এসব সমস্যাই পরিণত হয় মানসিক রোগে। একটি ছোট শিশুর সামনে বারবার বাবা-মায়ের ঝগড়া, গালাগালি, এমনকি খুনের ঘটনা তার মস্তিষ্কে যে ভয়াবহ ছাপ ফেলে, তা তাকে সারা জীবনের জন্য ভেঙে দিতে পারে। সমাধান ও করণীয় বর্ষার মতো আরও অনেক শিশুই আজ মানসিকভাবে বিপর্যস্ত, নিঃস্ব ও নির্ভরহীন জীবনের দিকে ধাবিত হচ্ছে। পরিবারই একটি শিশুর প্রথম শিক্ষা প্রতিষ্ঠান। সেখানে যদি ভালোবাসা, শ্রদ্ধা, নিরাপত্তা না থাকে, তাহলে সমাজও এক বিপন্ন প্রজন্মের জন্ম দেয়। বর্ষার চিকিৎসা চলছে, ধীরে ধীরে সে উন্নতির দিকে যাচ্ছে। তবে একদিনে সব ক্ষত মুছে যাবে না। তাকে প্রয়োজন হবে দীর্ঘমেয়াদি যত্ন, ভালবাসা, সহানুভূতি ও নিরাপদ পরিবেশ। শেষ কথা আসুন, আমরা সচেতন হই—বর্ষার মত আর কোনো শিশুর শৈশব যেন ট্রমায় পরিণত না হয়। পরিবারে শান্তি বজায় রাখি, শিশুর সামনে মানবিকতার উজ্জ্বল উদাহরণ স্থাপন করি। প্রতিজ্ঞাবদ্ধ হই, শিশুরা যেন নিরাপদ, সুন্দর ও ভালোবাসায় পূর্ণ এক শৈশব পায়। লেখক | আউলিয়া পারভীন |

আপনার অনুভূতি কী?






